মোঃ জাকির হোসেন | শুক্রবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ | পড়া হয়েছে 378 বার
রোহান থমথমে মুখে চায়ের টং-এ এসে দাঁড়ায়। তার চোখ মুখ বিরক্তিতে খিচে আছে। এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার নেই। আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। উঠেছে কথাটা ঠিক নয়। ওর মা টেনে তুলেছে। না উঠে উপায়ও ছিল না। যার সাথে দেখা করতে যাবে সে আজই ঢাকার বাইরে চলে যাবে। তার ট্রেন ছাড়বে দুপুর বারোটায়। অতএব তাকে নির্দিষ্ট টাইমের মধ্যে গিয়ে ধরতে হবে। এরকম বাধ্যবাধকতা ব্যাপরটা রোহানের ভালো লাগে না। নিজ স্বাধীন মতো চলাফেরা করতেই তার ভালো লাগে। বিষয়টা এমন সে কারও বসও নয় আবার কর্মচারীও নয়। নিজেই নিজের বস আবার কর্মচারী।
এই সাতসকালে মানুষ লাইন ধরে চা খাচ্ছে। বেঞ্চে বসার মতো জায়গা নেই। চা খেতে খেতে সবাই খোশ গল্প করছে। এক হাতে চায়ের কাপ অন্যহাতে সিগারেট। দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে সামনে ইলেকশন। নেতার পয়সায় হরদম চা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে!
একজন উঠে গেলে রোহান বেঞ্চে বসে।
মহল্লার টং দোকান। রোহান সকাল বিকাল এখানে চা সিগারেট খায়। টং দোকানের ছেলেটার নাম বুশ। অনেক দিন ধরে সে এখানে চা বিক্রি করে। বুশের চা বললেই মহল্লার সবাই এক নামে চেনে। ওর আসল নাম আলম। তবে ওই নামে এখন আর কেউ চেনে না। ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষ যখন সাদ্দামের নামে পাগল তখন সে কী মনে করে বুশের সাপোর্ট করেছিল। তখন থেকে তাকে সবাই বুশ বলে ডাকতে শুরু করেছে। ‘বুশের চা’ নামটা এখন এলাকায় প্রচলিত। পাশের মহল্লা থেকেও অনেকে স্পেশাল এক কাপ বুশের চা খেতে আসে।
বুশ এ সময় রোহানকে দেখে একটু আশ্চর্য হল।
‘রোহান ভাই আপনাকে চা দেব?’
‘দে এক কাপ।’
চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।
তখন মোবাইলে ফোন আসে।
ফোন রিসিভ করে মেজাজ আরও তেঁতে ওঠে। ধ্যত! যে জন্য সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠা সে কাজই আজ হবে না। সকালটাই মাটি হয়ে গেল। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন ঘরে ফিরে গিয়েও লাভ নেই। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছে।
নদীকে ফোন লাগায়। ফোন বিজি। শুধু টু টু আওয়াজ…। কিরে বাবা আজকে দিনটাই গোল্লায় যাবে নাকি? একটু পরে আবার ফোন দেয়।
এবার কপাল মনে হয় ভালো। নদী ফোন ধরে!
‘কেমন আছ নদী?’
‘ভালো। এতদিন পর হঠাৎ কী মনে করে?’
‘হঠাৎ কেন মনে পড়বে? তুমি তো মনের মধ্যেই পড়ে থাক। সময় হয় না এই যা…।’
হিঃ হিঃ করে হাসে নদী।
‘সক্কাল বেলা মজার একখান কথা হুনাইলা। তোমার আবার সময় হয় না, না? তুমি কর কী শুনি?’
‘শোন, মেয়েদের বয়স আর ছেলেদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নেই।’
‘কথা তো ভালোই শিখেছ।’
‘ভেতরে অনেক কথা জমে আছে। ঠিক মতো ডেলিভারী দিতে পারি না। ওই কী যেন একটা কবিতা আছে না?
“পাছে লোকে কিছু বলে।
করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ…।”
‘ইদানিং কাব্য চর্চাও শুরু করেছ নাকি?’
‘কবিতা ছাড়া প্রেম হয়, বল?’
‘বুঝেছি। তোমার মনে অনেক প্রেম জমেছে। এখন কী করতে হবে বল?’
‘নদী তোমাকে নিয়ে সাগরে হারিয়ে যাব।’
নদীর কণ্ঠে বিস্ময় ফোটে।
সত্যি!
তোমার সাথে মিথ্যে কখনও বলেছি?
‘উহ্! ঠাট্টা নয়। কোথায় যাবে বল না, কক্সবাজার?’
হাসে রোহান।
‘না-না, কক্সবাজার না। কুয়াকাটা। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দুটোই দেখব।’
তুমি দেখবে সূর্যোদয়! তবেই হয়েছে।
কেন সূর্যোদয় দেখা আমার জন্য মানা নাকি?
‘তুমি তো ভোর বেলা ঘুম থেকেই উঠতে পার না। সূর্যোদয় দেখবে কী করে?’
রোহান হাসতে হাসতে বলল।
‘সূর্যদয় দেখতে চাইনা। তোমার মুখ দর্শন করলেই চলবে।’
‘ওয়াওও…। তুমি মনে হয় দারুণ জোশে আছ।’
‘নদী একটা কথা বলব, রাগ করবে না তো?’
‘এতক্ষণ ধরে তো কত কথাই বললে রাগ করেছি?’
‘সাহস পাচ্ছি না, যদি বেঁকে বস।’
‘ভূমিকা না করে স্ট্রেইট বল।’
‘তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। একটু সময় করে আসবে?’
‘কোথায়?’
‘ধানমন্ডি লেকের পাড়।’
কখন?
‘তোমার যখন সুবিধা হয়। তুমি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকব।’
রোহানের অপেক্ষা বিফলে যায় না। শেষ বিকেলে নদী আসে বিজলীর চমক নিয়ে। মুখে রমণীয় হাসি পরণে ইট রং শাড়ি। তার সাথে ম্যাচিং করা পেঁয়াজ রংয়ের ব্লাউজ। চোখে মাশকারার আলতো টান। হাতে লাল-নীল চুড়ি। এক পায়ে নূপূর অন্য পা খালি।
সহজ অথচ আকষর্ণীয় সাজ দেখে মুগ্ধ রোহান। মুগ্ধ যেন প্রকৃতিও। সূর্য ডুবতে গিয়েও একটু যেন থমকে দাঁড়ায়। দিনের শেষ আলোর প্রক্ষেপণ ফেলে নদীর দিকে। শহুরে বিষাক্ত ধুলিমাখা পড়ন্ত বেলায় স্নিগ্ধ নদী নরম আলোয় বর্ণিল হয়।
লেকের দু’পাড় জুড়ে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। হঠাৎ তাকালে মনে হয় মানুষের মেলা বসেছে। স্বাভাবিক ছন্দে হাঁটার উপায় নেই। রোহান-নদী লেকের এক প্রান্ত ধরে হাঁটা শুরু করে। একটু বসার জন্য সুবিধা মতো জায়গা খোঁজে।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর ওরা একটা জায়গা পেয়ে যায়। লেকের দিকে মুখ করে পাশাপাশি বসে দু’জন। ওরা কোনো কথা নিয়েই মনোযোগী হতে পারে না। পালা করে নানা শ্রেণীর মানুষ আসে। ভিক্ষুক, চা-ওয়ালা, সিগারেট ওয়ালা,বাদাম ওয়ালা। একবার ভাবে উঠে যাবে। অন্য কোথাও নিরিবিলি বসবে। কিন্তু নিরিবিলি কোথায়? সবখানে একই অবস্থা। শেষে নানা বিরক্তির মাঝেও বসে থাকে ওরা। কথার ফাঁকে কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে আঁধার নেমে আসে টের পায় না। মানুষের চাপ কমতে থাকে। আস্তে আস্তে নীরবতা নেমে আসে।
লেকের টমমলে জলে পূর্ণ চাঁদের ছায়া। মৃদু ঢেউ-এ তিরতির করে কাঁপছে চাঁদ।
রোহান নদীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দেখছ কী সুন্দর চাঁদ।’
মাথা দোলায় নদী।
‘হু! আকাশের দিকে না তাকিয়েও দেখা যাচ্ছে। ভারী চমৎকার।’
নদীর সঙ্গে রোহানও সুর মেলায়।
‘সত্যি ভারী সুন্দর।’
‘কী!’ জানতে চায় নদী।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় নদীর দিকে।
‘তুমি।’
‘যাও! তুমি না সব কিছু বাড়িয়ে বল।’
‘না-না। বাড়িয়ে বলার মতো যথেষ্ট শব্দমালা আমার স্টকে নেই। তুমি সত্যি সুন্দর। চাঁদের চেয়েও।’
মৃদু লয়ে হাসে নদী।
‘মানুষ নেশায় বুদ হয়। আর তুমি আবেগে বুদ হয়েছ।’
রোহান ভ্যবলার মতো তাকায়। কথার স্টক শেষ হয়ে যায়।
এবার নদী শুরু করে। তার মুখ স্বাভাবিক।
‘রোহান থামলে কেন? বল। তোমার যা মনে আসে তাই বল। আমার শুনতে ভীষণ ভালো লাগছে। মানুষের জীবনে আবেগ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবেগ অনেকটা মশলার মতো। মশলা ছাড়া তরকারী যেমন বিস্বাদ হয় তেমন ভালোবাসাও আবেগ ছাড়া বৈচিত্রহীন হয়ে যায়।’
খুব মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে রোহান।
নদী শরীর দুলিয়ে হাসে।
তোমাকে মনে হচ্ছে ক্লাসের একজন মনোযোগী ছাত্র। মুখে কোনো রা শব্দ নেই। শুধু হা করে গিলছ।
‘তুমি যেরকম দামি দামি কথা বলছ না শুনে উপায় আছে।’
নদী রোহানের কান ধরে হ্যাঁচকা টান মারে। সুযোগ পেয়ে সাথে সাথে রোহান তার মাথা নদীর কোলে হেলিয়ে দেয়। নদী রোহানকে সরিয়ে দেয় না। বরং পরম আদরে তার মাথায় বিলি কাটে। মুহূর্তের মধ্যে জোছনার সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গীয় সুখ নেমে আসে।
একটু আগেও গাড়ির কালো ধোয়া আর শীশায় বাতাস যেখানে ভারী হয়েছিল এখন সেখানে আনন্দে ভরা মুক্ত বাতাস। বাতাস অক্সিজেনে ভরা। বাতাসে নাম না জানা ফুলের মউ মউ গন্ধ। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে ওরা। হঠাৎই যেন ঢাকা শহর বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। নদীর নরম হাতের ছোঁয়ায় রেহানের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আনন্দে তার শীশ দিতে ইচ্ছে করে।
সুখ ক্ষণস্থায়ী। শীতের সন্ধ্যায়ও কোথা থেকে কাল বৈশাখী ঝড় এসে হাজির হয়। জোসনার সব আলো কালো মেঘ এসে গ্রাস করে নেয়। কালো দানবের মতো দু’জন এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। পেছনে আরও দু’জন। ছায়ামূর্তি দেখে ধড়ফড়িয়ে ওঠে ওরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নদীর শরীরে খাবলা মারে একজন।
চিৎকার করে রোহান।
এ কেমন অসভ্যতা!
অশ্লিল ভাষায় গালি ছাড়ে পাশের জন।
চুপ! একদম চুপ!!
যে দু’জন একটু পেছনে ছিল পিস্তল হাতে এগিয়ে এসে ঘিরে দাঁড়ায়।
রোহানকে পিস্তল ঠেকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে,
‘ভাইজান চিৎকার চেঁচামেচি করার চেষ্টা কইরেন না। কোনো লাভ হবে না। বেশি ঝামেলা করলে আপনার পেয়ারের মাল তুইলা নিয়া যামু। সাথে আপনারেও। আপনে মজা করছেন আমরা দেখছি। এইবার আপনার মালের লগে আমরা মজা করমু আপনি চাইয়া চাইয়া দেখবেন।’
ভালো চাইলে চুপ কইরা একটু হাত তুইলা দাঁড়ান। আপনার কিচ্ছু করন লাগব না। যা করনের আমরাই করব। অস্ত্রের মুখে রোহান থরথর করে কাঁপতে থাকে।
চোখের পলকে রোহানের মানিব্যাগ আর মোবাইল কেড়ে নেয়। নদী ভয়ে কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে এখনই সে পড়ে যাবে। নদীর দিকে তাকিয়ে একজন বলল-
‘আপনার মোবাইলটা প্লিজ…।’
নদী কম্পিত হাতে মোবাইল তুলে দেয়। দু’তিন মিনিটের মধ্যে অপারেশন শেষ হয়। ওদের পাশ দিয়ে অনেক লোক হাঁটাহাঁটি করেছে কিন্তু কেউই বিষয়টি ধরতে পারেনি। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে সবাই বন্ধ-বান্ধব। একত্রে গল্প গুজব হাসি-ঠাট্টা করছে। কাজ শেষে ওদের দিকে পিস্তল তাক করে কমান্ড করে-
‘এখান থেকে সোজা চলে যাবি। পিছনে তাকাবি না। চিৎকার দিবি না। টু-শব্দ করলেই ফুটুস করে দিব।’
ওরা ভুলেও আর পেছনে তাকায় না। সোজা ছুটতে থাকে। এত জোরে পা চালায় তবু পথ শেষ হতে চায় না। এ পথ যেন কোনো দিন শেষ হবার নয়!
বাংলাদেশ সময়: ৫:০০ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
জাপানের প্রথম অনলাইন বাংলা পত্রিকা | pr placid