বাসব রায় | রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১ | পড়া হয়েছে 269 বার
-আচ্ছা তোমার চাকরির আর কতদিন ?
– চার/পাঁচ বছর হবে
– কতগুলো টাকা পাবে ?
– জানি না
– চল্লিশ পঞ্চাশ তো হবেই
– তো
– এটুকু তো মেয়ের বিয়ে দিতেই যাবে ৷ ভাবছি চাকরি শেষে তুমি কী করবে -!
– একটা বিয়ে করবো
ব্যাস্ এবার হলো —–
এতক্ষণ আমি একটাকিছু লিখবার প্লট তৈরি করছিলাম ৷ এরমাঝেই এসব উল্টোপাল্টা প্রশ্নে আমি জর্জরিত ৷ জবাব দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি ৷ একটার পর একটা প্রশ্ন সিরিয়াল কিলার ঢঙ্-এ ৷ শুরু হলো গ্রিক ট্রাজেডির এপিক থেকে ইলিয়াড বচন——–
– বিয়ে তো করবেই , জানি আমি ৷ বুড়ো ঢ্যামনা এখনও বিয়ের শখ যায় না ৷ মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা নেই ৷ উনি করবেন বিয়ে ৷ তো কমবয়েসি দেখেই করিও ৷ চাকুরি শেষের টাকাটা ওই হারামজাদীকে দিয়ো আর আমরা কীভাবে চলি , চলি – ৷ কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ শয়নকক্ষ ভেদ করে পাশের বাড়ি এবং অতঃপর পড়শীদের পর্যন্ত না পৌঁছানো অব্দি যে থামবে না পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার তাই বলে – ৷ লেখালেখির মুডটাই দিলো নষ্ট করে ৷ আমি ততোধিক নীরব এবং সংযমী হয়ে বাইরে যাওয়ার আয়োজন করছিলাম ৷ এমন সময়ে আমার কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েকে ডেকে এনে আমার বিবাহ করার খায়েশ সম্পর্কে বিস্তারিত দিক তুলে ধরতে লাগলেন ৷ আমি বড় অসহায় বোধ করছিলাম ৷ কি কথায় কী কথা -!
চিল্লাচিল্লি যথারীতি সি-সার্ভের র্সা পেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম ৷ ছেলেমেয়েরা মাকে থামাতে পারছে না ৷ ওরা আমার এমন নিঃস্ব এবং অসহায় পরিস্থিতি সম্পর্কে বরাবরই ওয়াকিবহাল ৷ সেজন্যই ওদের মাকে থামতে অনুরোধ করছে কিন্তু কে শোনে কার কথা -৷ মনমানসিকতা এতোটাই খারাপ হলো যে , ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করলো ,” হা ঈশ্বর ! তুমি আমাকে এখনই পজেটিভ করে দাও -; আর পারা যায় না ৷ ” ঈশ্বরের কানে হতভাগার আকুল আবেদন পৌঁছালো কিনা বুঝতে পারলাম না , কিন্তু একটা অনিশ্চিত ভালোলাগা কাজ করলো – যদি ঈশ্বর সত্যিই মঞ্জুর করেন আমার আবেদন ৷
সদর্পে বের হয়ে চললাম লকডাউন দেখতে ৷ ইচ্ছেটা এমন যে , পুলিশের লাঠির মার এমনভাবে খাই যেনো আজকের সান্ধ্যকালীন কষ্টটা অন্ততঃ ভুলে থাকা যায় ৷ কিন্তু পুলিশ আর প্রশাসনের গাড়ি আমাকে ক্রস করে উল্টোদিকে চলে গেলো ৷ ইচ্ছে করেই মাস্কটাস্ক সাথে নিইনি ৷ মরণপণ প্রতিজ্ঞা আজ আমার জীবনে সর্বোচ্চ খারাপটাই যেন আজ হয় ৷ কিন্তু পুলিশের গাড়ি দিব্যি চলে গেলো -৷
ঢুকলাম রাধা বাবুর চায়ের দোকানে ৷ লকডাউনে প্রশাসনের ভয়ে ছোট্ট একটা ফাঁক দিয়ে কোনমতে ভেতরে ঢুকে চা খাওয়া যায় ৷ যেকোনো সময় প্রশাসনের লোক আসতে পারে তাই সাবধানী ব্যবস্থা ৷ একটা কোণে বসে চা খাচ্ছি ৷ মনের ভেতর পারিবারিক ঝড় যেনো আরও বৃদ্ধি পেতে লাগলো – ৷ এখানে এমুহূর্তেই পুলিশ আসুক এবং আমাকে জেল-জরিমানা সহ বেধড়ক পিটুক ৷ হাসতে হাসতে আমি কারাবরণ করতে পারবো – ৷ অন্ততঃ তেজস্ক্রিয় ছড়ানো ভাষণের সামনে আর দাঁড়াব না কোনদিন ৷ বড় বিপজ্জনক হলো পুলিশের গাড়ির “প”-টারও দেখা নেই – ৷
বিগড়ানো মেজাজ নিয়ে রাত প্রায় দশটা নাগাদ বাসায় ফিরলাম ৷ সমন্বিত বোর্ডের প্রশ্ননির্বাচনের মাননীয় চেয়ারম্যান শুয়ে শুয়ে সিরিয়াল দেখছেন ৷ আমিও খুব গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে ফ্রেস হয়ে মোবাইল নিয়ে পাশেই শুয়ে পড়লাম আর বললাম আজ রাতে খাওয়ার ইচ্ছে মোটেই নেই , শরীরটা বেশ খারাপ ৷ এসব কথার প্রতিত্তোর হলো না দেখে অবাকই হলাম – ৷ কখনও কখনও বিরূপ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটলে খাপছাড়া লাগে বৈকি ৷ মনে হয় যাত্রাপালার শেষটা যুতসইভাবে হলো না ৷ যাহোক , শুয়ে পড়লাম উল্টোমুখো হয়ে – ৷ আমি যথারীতি মোবাইলে বিজি আছি – ৷ কিন্তু আধাঘন্টার মধ্যেই অনুভব করলাম শরীরটা বেশ জ্বর-জ্বর লাগছে ৷ রেগুলেটরের শেষ অব্দি ঘুরানো চাকার ফ্যানটা শরীর যেন মেনে নিতে পারছে না ৷ বেশ বুঝতে পারছি সান্ধ্যকালীন পজেটিভের প্রার্থনা এতক্ষণে ঈশ্বর মঞ্জুর করা শুরু করেছেন ৷
আমি খুব স্বাভাবিক আছি যেন আমার কিছুই হয়নি ৷ কিছুতেই যেন কারো শরীরের কোনো একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের টাচ না হয় সেভাবেই শুয়ে পড়েছি ৷ ইতিমধ্যেই মোবাইল রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছি ৷ ভাবছি সত্যিই যদি পজেটিভ হয় তাহলে আমাকে এদের থেকে দূরত্বে থাকা দরকার কিন্তু এসব বলতেও পারছি না ৷ একটা নাপা জাতীয় ট্যাবলেট খেয়েছি কিন্তু কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল না ৷ একই খাটে আর কতোটা দূরত্ব মানা যায় ৷ আমার গায়ে ওনার হাত না পা পড়লো আর অমনি সচিৎকারে ” তোমার গায়ে তো জ্বর , এতক্ষণ বলোনি কেনো – ! আমি তো খেয়ালই করিনি ; ভাবলাম রেগে আছো তাই হয়তো খেলে না বা কথা বলছো না ! হায় হায় — এখন আমার কী হবে !! জ্বর কমানোর যাবতীয় এ্যারেঞ্জ শুরু হয়ে গেলো ৷ দু’এক জায়গায় মোবাইল করে জেনে নেয়া হলো এখন এরূপ অবস্থায় করণীয় কী – ইত্যাদি ৷ আমি জোর দিয়ে বললাম ,” তুমি ও-ঘরে যাও , আমার কিচ্ছু হবে না আর ছেলেমেয়েদের এঘরে আসতে দিয়ো না ৷” কে শোনে কার কথা !
ঠিক আজকের সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী এযাবতকালের সর্বোচ্চ মৃত্যু এবং আক্রান্তের হার সারাদেশে ৷ উনি মরিয়া হয়ে গরমজলের ভাপ , লেবু আর লবনজলের গারগিল ইত্যাদি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন ৷ আমি মনে মনে ঈশ্বরকে বহুবার প্রণাম করলাম এবং এরপর যদি চরম পরিণতির দিকেও যাই আর দুঃখ নেই – ৷ প্রসন্নচিত্তে পরবর্তী ঘটনাবলীর অদৃশ্য চিত্রায়ণ ভাবতে লাগলাম – ৷ মান্না দে’র গানের একটা কলি এভাবে সুরে সুরে বাজছে আমার অন্তরে ,” আবার হবে কী দেখা , এ দেখাই শেষ দেখা হয়তো—-!”
কখন কিভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না ৷ রাত সাড়ে তিনটায় প্রকৃতির আহ্বানে জেগে দেখি , উনি আমার বালিশের ওপর একধারে আধাশোয়া হয়ে আধো-আধো ঘুমে লবনজলের গেলাস হাতে তখনও – ৷ আমার ওঠার শব্দে জেগে ওঠেই দৌড়ে বাথরুমের গেট পর্যন্ত গেলেন ৷ বিছানায় এসে যখন বসলাম তখন আর গায়ে জ্বর নেই ৷ ফ্রেস লাগছে – ৷ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবুও উনি পরদিন টেস্টের জন্যে নিয়ে যাবেন বলে স্থির করলেন ৷ আমি জানি , ঈশ্বর একটু মজা করলেন আর এমন মজার ফাঁকেই জং-ধরা প্রেমটাকে সামান্য ঘষামাজা করিয়ে দিলেন ৷
বাংলাদেশ সময়: ১২:২২ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১
জাপানের প্রথম অনলাইন বাংলা পত্রিকা | rita rita