মিঠুন দাস, ছাইতামা, জাপান | বুধবার, ১২ মে ২০২১ | পড়া হয়েছে 298 বার
আমি ছোট বেলা থেকে এপর্যন্ত বেড়ে উঠেছি যৌথ পরিবারে। যদিও সময়ের সাথে বাস্তবতাকে মেনে নিতে আমাদের সেই যৌথ পরিবার একসময় ভেঙ্গে যায়। তবে আমার উপর পরিবারের সেই বিচ্ছিন্ন হবার প্রভাব পড়েনি। মা কখনো আমাকে বাড়িতে একা রেখে কোথাও বেড়াতে গেলে, নিজের খাবার তৈরির কিছুটা হলেও চাপ আসতো, সেই চাপের মধ্যে একটি হচ্ছে ভাত রান্না করা। তাও রান্না করতাম কেবল আমার জন্যই নয়, বলতে গেলে ভাত রান্না করেছি বাড়িতে যে হাঁস মুরগি ছিল তাদের কথা ভেবেই । মা বাড়িতে আমাকে রেখে অন্য কোথাও চলে গেলে আমার খাওয়ার জোগাড় আরো বেশি হতো।
এসময় দেখা যেতো বাড়িতে অন্য কারো ঘরে রান্না শেষ হলে কাকিমাদের কাছ থেকে বাটি ভরে তরকারি নিয়ে আসতো তারা আমার জন্য। আর বাবা বাড়িতে থাকলে মাঝে মাঝে বাবাও রান্না করতেন। যদিও আমার ছোট এক বোন রয়েছে, ছোট বোনের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি কখনো। সে বড় হয়ে পরিবারে অন্যদের জন্য রান্না করার যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই আমাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। সত্যি বলতে আমার ছোট ভাই ভালো মাছের ভাজি বা কারি রান্না করতে পারে। তাই তাদের উপর ভরসা করেই আমার চলে যেত সেই সময়কার দিন।
গ্রাম থেকে পড়াশোনার করার জন্য যখন ঢাকা শহরে চলে আসি তখন ঢাকার বাসায় থাকা অবস্থায় রান্নার দায়িত্ব ছিল পুরোটা বুয়ার উপর। আর যেদিন বুয়া না আসতো সে দায়িত্বটা পালন করত আমারই এক রুম মেট, বন্ধু। তাই বলতে পারি দেশ কোনো দিন আমাকে রান্নায় হাত লাগাতে হয় নি। তবে রান্নার কাজে সহযোগিতা করতে তরকারি কাটাকাটি করে দিয়েছি অনেক।
এরপর যখন প্রথম বিদেশের মাটি হিসেবে ভারতে পা রেখেছিলাম তখন আমাদের গ্রুপে আমরা ছিলাম তিনজন। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে একজন মেয়ে ছিল। সেই মেয়েই আমাদের রান্নার কাজটি করতো। তাই বলা যায়, সেই যাত্রায় রান্না করার দায়িত্ব পালন না করা থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। তখন আমার দায়িত্ব ছিল শুধু বাজার করে দেওয়া আর পুরানো সেই সবজি কাটাকাটি করে দেওয়া। কিন্তু এই শিক্ষাটা ধোপে টেকেনি যখন আমি সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসে জাপানের মাটিতে পা রাখি। কাটাকাটি করে আর বেশিদূর আগাতে পারলাম না।
জাপান আসার পর প্রথমই বুঝতে পারি এটা যে এক ভিন্ন জগৎ। এখানে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। ইন্ডিয়া থাকা অবস্থায় যদিও এক বেলার খাবার বাইরে থেকে আনা হতো। জাপানে এসে তার অতো সুযোগ নেই। আমার মনে পড়ে, জাপানে এসে প্রথম দিন ডিমের তরকারি রান্না করেছিলাম। আমার রান্না করা সেটা কোনো তরকারি হয়েছিল কিনা তা নিজেই সঠিক বুঝতে পারিনি। তাই অন্যদের বলে বোঝানো কষ্টকর।
রান্না করতে যে ময়-মসলা কষাতে হয় তা জেনেছিলাম জাপান আসার অনেকদিন পর। আমার ওই মসলা ভাসা ডিমের ঝোল দিয়ে চালিয়েছিলাম দুই দিন। তাতে না পেয়েছিলাম ডিমের স্বাদ না পেয়েছিলাম জলের কোনো স্বাদ। সেসময় দুপুরের খাবারটা অফিস থেকে সরবরাহ করতো। তাই বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম। এর পর নিজে রান্না করবো মনে করে কোনো দিন রান্নার আগে কয়েক ঘন্টা ইউটিউবে ভিডিও দেখে নিয়েছি। কিন্তু যখনই বাস্তবে চুলায় পাতিল বসিয়ে মসলা দেবার আগে আগুন জ্বালিয়েছি তখন রান্না করার সময় সব নিয়ম নীতি বা পদ্ধতির কথা গুলিয়ে ফেলেছি।
এমন কী, ইউটিউবে যে ময়-মসলার কথা বলা হতো তার অধিকাংশই আমার কাছে ছিলো না। বিদেশের বাড়িতে হালাল ফুড নামে কিছু দোকান রয়েছে যেখানে দেশীয় মসলা সহ অন্যান্য সামগ্রী পাওয়া যায়, এই তথ্যটি পেতেও আমার আবার কয়েক মাস সময় লেগেছিল। প্রথমে যখন মসলা গুলো আমি কিনতে যাই তখনই নিজের কাছে এক ধরনের আনন্দ লাগে। এরপর যখন কিনেছি তখন মনে মনে আরো বেশি আনন্দে আন্দোলিত হয়েছিলাম। নিজের মনেই সাহস দেখাই এই বলে যে, এবার সত্যি সত্যিই আমি রান্না করে দেখিয়ে দিব, আমি পারি কিনা। সেই যে সাহস করি সেই রান্না করার সাহস দেখানো আমি আজও দেখাতে পারলাম না। এর পর আমি কতো যে গুরু ধরলাম, কতো সাধনা কতো তপস্যা, সবই আমার বিফলে গেল।
ইউটিউব থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, মা, বোন, আত্মীয়স্বজন সবার কাছ থেকে রান্নার টিপস নিয়েছি। আজও কিছু তে কিছু করতে পারলাম না। এজন্য নিজেই নিজেকে এখন বলি, বৎস তোমার সাধ্য এ পর্যন্তই। রান্নার সাধনা করেও তোমার আর লাভ নেই। পাশে এলাকার এক বড় ভাইয়ের সাথে কয়েক দিন এখানে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। যতটা দেখেছি, উনার রান্নার হাত খুবই ভালো। রান্নার হাত ভালো থাকলে যা হয়, রান্নার দায়িত্ব উনার হাত থেকে কোনোদিনই আমার হাতে নিতে পারিনি। তাই কারি রান্না করাটা আমার আর শিখা হয়ে ওঠেনি।
পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন সময় কাটিয়েছি মুন্সীগঞ্জের এক বড় ভাইয়ের সাথে। তাদের রান্নার ধরন আবার আমাদের এলাকার রান্নার পদ্ধতি থেকে অনেকটা আলাদা। তিনি আমাকে আলু দিয়ে ডালের তরকারি তৈরি করেও খাইয়েছেন। বিগত প্রায় ছয় মাস সময় কাটিয়েছি কিছু নেপালিদের সাথে। লক্ষ করে দেখলাম, শর্টকাট রান্নার এক বিশাল রেসিপি জানা রয়েছে তাদের হাতে। তারা অনেক অল্প সময়ে খুব সুস্বাদু রান্না করতে পারে। সত্যি বলতে ওদের আমি প্রথম দেখলাম এতো সহজে এবং অল্প সময়ে এতো ভালো রান্না করতে পারে। কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে এরা মাছ খায় কম। খরচ বাঁচাতে কিনা জানি না তবে আমার মনে হয় সহজে রান্নার সুবির্ধার্থে বেশি করে শুধু মাংস খায়। তাদের সাথে ছয় মাস সময় থাকারকালেমনে হয় মাত্র একদিন মাছ খেয়েছি।
বর্তমানে আবার একা হলাম। তবে রান্নার হাত ভালো হয়েছে ততটুকুই যতোটুকু অতি সন্ন্যাসীতে হয়। এতো তপস্যার পর ভাগ্যদেবতাকে তুষ্ট করতে পেরেছিলাম। আমাকে বললেন, বৎস্য, অনেক কষ্ট করেছ আর নয় এবার তোমার সাধনায় আমি তুষ্ট হলাম। কিন্তু সাধনার এই মাঝপথে এসেও যেন সাধনার ফলাফল নষ্ট করে দিলো করোনা নামক এক দৈত্য। সে এসে আমার থালায় ভাগ বসিয়ে দিল। সবই আমার কপাল।
বাংলাদেশ সময়: ১২:১৪ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১২ মে ২০২১
জাপানের প্রথম অনলাইন বাংলা পত্রিকা | pr placid